• শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১১ অপরাহ্ন

৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন: গণতন্ত্রের উৎসব নাকি সহিংসতার আতঙ্ক?

নিজস্ব প্রতিবেদক / ৪৩
বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
WhatsApp Image 2025 09 10 at 2.08.09 PM

৩৫ বছর পর বহুল প্রতীক্ষিত চাকসু নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একসময় মুখর হয়ে উঠলেও আগস্টের সহিংসতায় সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন একটাই – ভোট হবে তো? নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভরপুর ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের উৎসব আবারও পিছিয়ে যাবে?

সহিংস রাত থেকে অচল ক্যাম্পাস

৩০ আগস্ট গভীর রাতে এক ছাত্রীকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ সংঘর্ষ বাঁধে। প্রথম দফায় আহত হন অন্তত ৭০ জন শিক্ষার্থী। রাত সাড়ে তিনটার দিকে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও এর পরদিন দুপুরে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। তাতে আহত হন প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাদের। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে পাঠদান, ক্লাস, পরীক্ষা সব কিছুই স্থবির হয়ে পড়ে। শুরু হয় একের পর এক মশাল মিছিল, লাল কার্ড প্রদর্শন, শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি। চাকসু নির্বাচন আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নয়, এখন শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি—নিরাপত্তা ও প্রশাসনের জবাবদিহি।

ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনে নেমেছে একসঙ্গে। তাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা বারবার হামলার শিকার হলেও প্রশাসন কোনো দায় স্বীকার করেনি, বরং দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। নারী অঙ্গন নামের একটি সংগঠন লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে, প্রক্টর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, নারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেছেন এবং সান্ধ্য আইন জারি করে ক্যাম্পাসকে নারীবিদ্বেষী পরিবেশে পরিণত করেছেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে হল ছেড়ে মেস বা কটেজ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলেও বই–খাতা হাতে নেওয়ার মতো পরিবেশ পাচ্ছেন না কেউ। নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিমের ভাষায়, “বাসা হারিয়ে শিক্ষার্থীরা দিশাহারা। এখন টিকে থাকাটাই মূল বিষয়।” বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ নুহ বললেন—“এত বছর পর নির্বাচন হচ্ছে, তবে তা অবশ্যই নিরাপদ পরিবেশেই হওয়া উচিত। বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই অনিশ্চিত।”

কমিশনের প্রস্তুতিতে ধাক্কা

সহিংসতার মধ্যেই ১ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় ভোটার সংখ্যা ধরা হয় ২৫ হাজার ৮৬৬ জন। প্রথমে আপত্তি জানানোর শেষ তারিখ ছিল ৪ সেপ্টেম্বর, কিন্তু সংঘর্ষের কারণে সেটি বাড়িয়ে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এতে শুরুতেই ধাক্কা খায় কমিশনের প্রস্তুতি। যদিও কমিশনের ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে মনোনয়ন ফরম বিতরণ, ২৫ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ এবং ১২ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের ঘোষণা বহাল রাখা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মনির উদ্দিন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন -“নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রশাসনের দায়িত্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।”

প্রশাসনের আশ্বাস বনাম শিক্ষার্থীদের অবিশ্বাস

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. সাইফুল ইসলাম দাবি করেছেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের প্রশ্ন—যারা এত বড় সহিংসতার দায় নিতেও অস্বীকার করে, তারা কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবে?

দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও বর্তমান অনিশ্চয়তা

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ছয়বার অনুষ্ঠিত হয়েছে চাকসু নির্বাচন। সর্বশেষ হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তিন দশকেরও বেশি সময় পর বহুল প্রতীক্ষিত সেই নির্বাচনের আয়োজন এখন অনিশ্চয়তায় ঢাকা। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা, বাসস্থান সংকট ও নিরাপত্তাহীনতায় দিশাহারা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অভিমত স্পষ্ট, “চাকসু নির্বাচন অবশ্যই হওয়া উচিত, তবে তা যেন হয় ভয়হীন, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে।”


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ