
চট্টগ্রাম মহানগর চারটি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নগরের রাজনীতিতে ইতোমধ্যেই জমে উঠেছে সরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ঐতিহ্যগতভাবে এই আসনগুলোতে বিএনপির প্রভাব থাকলেও মাঠ পর্যায়ে সংগঠিতভাবে প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছে জামায়াতে ইসলামি। তারা একক প্রার্থী ঘোষণা করে গণসংযোগ, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিএনপির ভেতরে মনোনয়ন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে দিন দিন।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে বিএনপি। এ কারণে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়েছে, আর এরই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। যদিও দলের নেতারা আশাবাদী— নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হলে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নেতাকর্মীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবেন।
চান্দগাঁও, বোয়ালখালী ও পাঁচলাইশ এলাকার অংশ নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসন। এখানে বিএনপির তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থী তৎপর রয়েছেন। তাদের মধ্যে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও মহানগর আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আবু সুফিয়ান এর আগে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন।
এই আসনের প্রধান সমস্যা কালুরঘাট সেতুর অভাব ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। প্রতিটি নির্বাচনে সমাধানের প্রতিশ্রুতি এলেও বাস্তবে অগ্রগতি হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চট্টগ্রাম সফরে কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন ভোটারদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। স্থানীয়দের প্রত্যাশা— এবার এমন একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, যিনি জলাবদ্ধতা নিরসন ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন।
কোতোয়ালী ও বাকলিয়া এলাকা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৯ আসনকে নগরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ধরা হয়। বর্তমানে আসনটি বিএনপি নেতা ও সিটি মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তিনি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
তবে এবার মনোনয়নের দৌড়ে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বকর এবং শিল্পপতি শামসুল আলমও। এর মধ্যে বকর মাঠপর্যায়ে শুরু থেকেই বেশ সক্রিয়।
এই আসনের ভোটারদের প্রধান দুর্ভোগ— জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অব্যবস্থা, যানজট, ছিনতাই ও ফুটপাত দখল। অপরিকল্পিত নগরায়ণ জনজীবনকে প্রতিনিয়ত দুর্বিষহ করে তুলেছে। নাগরিকরা এবার এমন একজন কর্মঠ ও সৎ প্রার্থী চান, যিনি দলীয় সীমারেখার বাইরে গিয়ে শহরকে বাসযোগ্য করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, হালিশহর ও খুলশী এলাকা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১০ আসন বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঘাঁটি। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে সাঈদ আল নোমান রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে অনুসারীদের মাঠে টেনে এনেছেন।
অন্যদিকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও এ আসন থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর ছেলে ইসরাফিল খসরুও সক্রিয় হয়েছেন। ফলে সাঈদ আল নোমান ও ইসরাফিল খসরুর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দেখা যাচ্ছে।
এই আসনের বড় অংশ শ্রমজীবী ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। তাদের প্রধান চাহিদা— ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ আবাসন ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা।
বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড ও সদরঘাট নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১১ আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে একক প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। যদিও তিনি চট্টগ্রাম-১০ আসনেও সক্রিয়, তবে স্থানীয় নেতাদের মতে, শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম-১১ থেকেই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এই আসনের ভোটাররা অভিযোগ করেন— বর্তমান সাংসদ এম এ লতিফ চেম্বারভিত্তিক রাজনীতিতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন, সাধারণ মানুষের পাশে তার ভূমিকা ছিল না।
অবৈধ দখল, বিশুদ্ধ পানির সংকট, বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যা ও পরিবেশ ধ্বংস এখন প্রধান জনদুর্ভোগ। স্থানীয়দের আশা— এবার এমন একজন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন, যিনি পাহাড় রক্ষা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
চট্টগ্রাম মহানগরের চার আসনে ভোটার সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। বিএনপির ভেতরে মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও মাঠে জামায়াত সুসংগঠিত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোন দল বা প্রার্থী ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারেন, সেটিই নির্ধারণ করবে মহানগরের রাজনৈতিক সমীকরণ।
এআরই/দেশবিদেশ