
মানবজাতির ইতিহাস মূলত এক অবিরাম অভিযাত্রার নাম-যেখানে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতি। সেই অভিযাত্রার সূচনালগ্নেই অর্থনৈতিক লেনদেনের অঙ্কুরোদ্গম; এক কালের মানুষ, যার সম্পদ ছিল তার শ্রম, খাদ্য কিংবা গৃহপালিত পশু, সে বিনিময়ের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিল পারস্পরিক নির্ভরতার এক অনাড়ম্বর অথচ মৌলিক সমাজ। সময়ের প্রবাহে যখন সভ্যতার চাকা ঘুরে চলল, বিনিময়ের সরল ছন্দে এল জটিলতা, আর তখনই আবির্ভাব ঘটল ধাতব মুদ্রার-স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা তামার চকচকে মুদ্রা কেবল সম্পদের মূল্য নয়, রাষ্ট্রের মর্যাদা, শাসকের প্রতাপ ও জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠল।
এরপর ইতিহাসের পাতায় সূচিত হয় আরেক বিপ্লব-কাগুজে মুদ্রার আবিষ্কার, যা ধাতব ভারমুক্ত এক সহজাত গতি ও বিস্তারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আর আজকের দিনে, আমরা এসে দাঁড়িয়েছি ডিজিটাল আর্থিক যুগের দোরগোড়ায়, যেখানে মুদ্রার রূপ নেই, ধ্বনি নেই-আছে কেবল এক অদৃশ্য সংকেতের ভাসমানতা, যা মোবাইল কিংবা কার্ডের স্পর্শে সম্পন্ন করছে কোটি কোটি টাকার লেনদেন।
এই দীর্ঘ আর্থিক অভিযাত্রা কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতির গল্প নয়; এটি একটি সমাজের চিন্তা, মানুষের মানসিকতা, স্বাধীনতা, শ্রেণিবিন্যাস, রাষ্ট্র¶মতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে এক গভীর পুনর্বিচার। যখন একদিকে আমরা ক্যাশলেস লেনদেনের অভাবনীয় গতি ও সুবিধার দিকে ধাবিত হচ্ছি, অন্যদিকে প্রশ্ন উঠছে-এই ব্যবস্থায় আমাদের সম্পদের প্রকৃত মালিক কে? আমরা কি হারাচ্ছি ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও আস্থার সেই স্থিতিস্থাপক ভিত্তি?
এই প্রবন্ধে আমরা অনুসন্ধান করব অর্থ ব্যবস্থার সেই উত্তরণের গল্প-যেখানে বিনিময় পদ্ধতির আদিমতা থেকে শুরু করে আধুনিক ব্যাংকিং ও ক্যাশলেস ব্যবস্থার জটিলতায় পৌঁছে গেছি। পাশাপাশি আমরা নববী যুগের স্বচ্ছ ও নিরাপদ অর্থব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে খুঁজে দেখব-মানবতার ভবিষ্যৎ কি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাশলেস ব্যবস্থার ঝুঁকিতে, না কি নববী ঐতিহ্যের বাস্তব নির্ভরশীলতা আমাদের পথনির্দেশ দিতে পারে?
আধুনিক ব্যাংক নোট বা মুদ্রার আবিষ্কারের বহু পূর্বে, মানব সভ্যতা অর্থনৈতিক লেনদেন পরিচালনা করত বিনিময় বা ইধৎঃবৎ পদ্ধতির মাধ্যমে। অর্থাৎ, কোনো নির্দিষ্ট মুদ্রার ব্যবহারের পরিবর্তে পণ্য বা সেবার সরাসরি বিনিময় ঘটতো, যা ছিল একটি প্রাচীন ও সহজাত লেনদেন পদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষক ধান উৎপাদন করতেন এবং এক জেলে মাছ ধরতেন; তারা একে অপরের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য বিনিময় করতেন- কৃষক তার উৎপাদিত ধানের নির্দিষ্ট পরিমাণ জেলেকে দিতেন, আর বিনিময়ে পেতেন মাছ। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ‘মুদ্রা’ বা ‘টাকার’ ভূমিকা থাকত না, বরং পারস্পরিক সম্মতি ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে লেনদেন সম্পন্ন হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধান, গবাদি পশু, লবণ, চামড়া, তামা, রুপা ইত্যাদি পণ্যসমূহ লেনদেনের মানদণ্ডে পরিণত হতে থাকে। এই পদ্ধতিই অর্থনীতিতে ‘বার্টার’ বা বিনিময় ব্যবস্থা নামে পরিচিত। কিন্তু এই পদ্ধতির অন্তর্নিহিত জটিলতা যেমন সমতুল্য মূল্যের নির্ধারণে অসুবিধা, তেমনি পণ্যের সংরক্ষণ¶যোগ্যতা ও বহনযোগ্যতার সীমাবদ্ধতা পরবর্তীতে ধাতব মুদ্রার আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছিল।
Graeber, David. Debt: The First 5,000 Years. Melville House, 2011.
পণ্যের বিনিময় পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে মানুষ যখন ধাতব পদার্থকে মূল্যমান হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করে, তখন থেকেই ধাতব মুদ্রার ইতিহাসের সূত্রপাত। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ সালের দিকে মিশর, সুমের, চীন ও ভারতীয় উপমহাদেশে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তামার মতো ধাতু লেনদেনের মাধ্যমে ব্যবহৃত হতো। এগুলো ছিল নিছক নির্দিষ্ট ওজনের ধাতব খণ্ড, যার পেছনে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুমোদন বা মান নির্ধারণ ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের নির্ভরযোগ্যতা ও অভিন্ন মানদণ্ডের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হলে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে বর্তমান তুরস্কের লিডিয়া রাজ্যে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে মুদ্রা চালু হয়। রাজা আলিয়াস অথবা তার পুত্র ক্রোসাস ইলেকট্রাম (স্বর্ণ ও রৌপ্যের প্রাকৃতিক মিশ্রণ) দিয়ে তৈরি এই মুদ্রাগুলোর ওপর রাজচিহ্ন বসিয়ে তা আইনি স্বীকৃতি প্রদান করেন-এটি ছিল আধুনিক মুদ্রাব্যবস্থার প্রথম নিদর্শন। ভারতীয় উপমহাদেশেও একই সময়ে মাহাজনপদ যুগে পাঞ্চমার্কড কয়েন নামে পরিচিত একাধিক প্রতীকসংবলিত রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত হয়। পরবর্তী সময়ে মৌর্য গুপ্ত ও কুষাণ রাজবংশের শাসনামলে রাজচিহ্নসংবলিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা চালু হয়, যা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও করব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। ইসলামী খেলাফতের অধীনেও ধাতব মুদ্রা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। প্রথমদিকে রোমান ও পারস্য মুদ্রা ব্যবহৃত হলেও খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ৭৯ হিজরিতে (৬৯৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রথম স্বাধীন ইসলামী স্বর্ণ দিনার ও রৌপ্য দিরহাম প্রবর্তন করেন। এই মুদ্রাগুলোতে নির্ধারিত ওজন, বিশুদ্ধতা এবং ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে কুরআনের আয়াত, নবী ﷺ-এর নাম ও তাওহিদের বার্তা উৎকীর্ণ থাকত। মুসলিম জগতে এই ধাতব মুদ্রাব্যবস্থা দীর্ঘকালব্যাপী একটি স্থিতিশীল, ইনসাফপূর্ণ ও বিশ্বস্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে কার্যকর ছিল।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ মারে রথবার্ডের ভাষ্যমতে, বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম কাগজের মুদ্রা বা ব্যাংক নোট চালু হয় চীনে, তাং রাজবংশের আমলে (৭ম থেকে ১০ম শতক)। যদিও সে সময়ে এটি সীমিত আকারে এবং আঞ্চলিকভাবে ব্যবহৃত হতো, আনুষ্ঠানিকভাবে কাগুজে মুদ্রা চালু হয় ১০২০ খ্রিস্টাব্দে, সঙ রাজবংশের অধীনে। “জিয়াওজি” নামে একটি সরকারি নোট জারি করে তারা কাগজের মুদ্রাকে স্বীকৃতি দেয়, যা প্রাচীন চীনের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
ইউরোপে কাগজের মুদ্রার প্রচলন হয় অনেক পরে-১৬৬১ সালে সুইডেনে, যখন স্টকহোম ব্যাংক প্রথমবারের মতো ব্যাংক ইস্যুকৃত নোট চালু করে। ১৭শ শতকে এই প্রবণতা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং ডাচ প্রজাতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬৯৪ সালে ইংল্যান্ডে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠার পর কাগজের মুদ্রা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এসব নোট প্রাথমিকভাবে স্বর্ণ বা রৌপ্যের মাধ্যমে সমর্থিত ছিল-অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যবান ধাতু জমা রাখার বিপরীতে ব্যাংক নোট ইস্যু হতো এবং চাইলে তা পুনরায় ধাতুতে রূপান্তর সম্ভব ছিল।
১৮শ ও ১৯শ শতকে ঔপনিবেশিক বিস্তার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্পবিপ্লবের কারণে কাগজের মুদ্রা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। রেলপথ, টেলিগ্রাফ এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে ব্যাংক নোট একক ও নির্ভরযোগ্য লেনদেন মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেটন উডসে একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠন ও একটি বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো গঠনের প্রয়াস নেওয়া হয়। এই চুক্তির আওতায় ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং অন্যান্য দেশের মুদ্রাগুলো নির্দিষ্ট হারে ডলারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সেইসঙ্গে, ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় (১ আউন্স স্বর্ণ = ৩৫ ডলার), যা এ ব্যবস্থাকে “স্বর্ণ-মান নির্ভর পদ্ধতি” হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
তবে ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই স্বর্ণ বিনিময় প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করেন, যার ফলে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট বা ভাসমান বিনিময় হারের যুগ শুরু হয় এবং ‘ফিয়াট মানি’ নামে পরিচিত নতুন এক মুদ্রাব্যবস্থার সূচনা হয়। এই ব্যবস্থায় কোনো মুদ্রা স্বর্ণ বা অন্য কোনো বস্তুগত সম্পদের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং সরকার কর্তৃক বৈধ মুদ্রা হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে তার মূল্য স্থির থাকে।
আজকের দুনিয়ায় বাংলাদেশি টাকা (৳), মার্কিন ডলার (৳), ভারতীয় রুপি (₹), কিংবা ইউরোপীয় ইউরো (€)-এসবই ফিয়াট মানি; এসবের পেছনে সরাসরি কোনো স্বর্ণ বা সম্পদের সমর্থন নেই। জনগণ এগুলো ব্যবহার করে কারণ সরকার তা বৈধ বলে ঘোষণা করেছে এবং সমাজে তা গৃহীত।
সূত্র :Rothbard, Murray N. What Has Government Done to Our Money? Auburn, AL: Ludwig von Mises Institute, 2005.
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ফিয়াট মানির ওপর, যার নির্ভরশীলতা ক্রমশ কমে আসছে ডিজিটাল আর্থিক প্রযুক্তির বিকাশের কারণে। এই আধুনিক যুগে নগদহীন বা ক্যাশলেস ব্যাংক ব্যবস্থা দ্রুত প্রসার লাভ করছে, যেখানে লেনদেনের জন্য হাতে নগদ টাকা না নিয়ে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং ফিনটেক (আর্থিক প্রযুক্তি) এই পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি।
ক্যাশলেস ব্যবস্থার মূল উপাদানগুলো হলো : মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস (গঋঝ) যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং ওই-ওয়ালেট, ছয় কোড পেমেন্ট, পস (চড়রহঃ ড়ভ ঝধষব) মেশিন
নগদহীন অর্থব্যবস্থায় অগ্রগামী দেশসমূহ
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ নগদহীন বা ক্যাশলেস অর্থব্যবস্থায় দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া ক্যাশলেস লেনদেনের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে ইউরোপের নর্ডিক দেশগুলো-সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্কে ক্যাশলেস লেনদেন ব্যাপক মাত্রায় চালু রয়েছে। সুইডেনে বর্তমানে মাত্র ১০ শতাংশেরও কম মানুষ নগদ ব্যবহার করেন। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কেও প্রায় ৯০ শতাংশ লেনদেন ক্যাশলেস পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। অর্থনীতিবিদ ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, সুইডেন বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ক্যাশলেস দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০২৪)।
চীন বহু আগেই আলিপে, উইচ্যাট পে ও টেনসেন্ট পেমেন্টের মাধ্যমে মোবাইল পেমেন্ট চালু করেছে। বর্তমানে দেশটির অধিকাংশ লেনদেনই স্পর্শবিহীন ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। সরকার ‘ডিজিটাল ইউয়ান’ চালুর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যার ৬০% মোবাইল পেমেন্টে যুক্ত হওয়ার ল¶্য থাকলেও, ২০২৪ সালেই প্রায় ৬৮% মানুষ এই ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে (প্রথম আলো, ২০২৪)।
ভারতও ডিজিটাল লেনদেনে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর ভারতের ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের সম্মিলিত লেনদেনের চেয়ে বেশি ছিল। ভারতের ইউপিআই (টহরভরবফ চধুসবহঃং ওহঃবৎভধপব), মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম ও ডিজিটাল ব্যাংকিং দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে ক্যাশলেস লেনদেনের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভারতের জনগণের একটি বড়ো অংশ এখন ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করছে এবং দেশটি ক্যাশলেস সোসাইটির পথে দৃঢ়পদে এগিয়ে যাচ্ছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০২৩)।
বাংলাদেশে ক্যাশলেস ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রা : একটি চলমান বাস্তবতা
বাংলাদেশে ক্যাশলেস ব্যাংকিংয়ের অগ্রগতি এখন আর কেবল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নয়, বরং এটি একটি চলমান বাস্তবতা। ২০১১ সালে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) চালুর মাধ্যমে ডিজিটাল লেনদেনের সূচনা হলেও, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগানে বাংলাদেশ ব্যাংক এই রূপান্তরকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় (দৈনিক প্রথম আলো, ২০২৩)।
ছয় কোড নির্ভর “বাংলা কিউআর” চালুর মাধ্যমে চা দোকান, মুদি দোকান, হোটেল, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা থেকে শুরু করে নগর জীবনের সব স্তরে ডিজিটাল লেনদেনের কার্যক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে ১০টি ব্যাংক, তিনটি মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিমকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মহাপরিকল্পনার নেতৃত্ব দিচ্ছে (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০২৪)।
ইতোমধ্যে মতিঝিল এলাকার প্রায় ১,২০০ ¶রৌদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীকে নগদমুক্ত লেনদেনের আওতায় আনা হয়েছে এবং ধাপে ধাপে সারা দেশে এই সেবা বিস্তারের ল¶দ্য রয়েছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০২৪)।
সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে মোট লেনদেনের ৩০%, ২০২৭ সালের মধ্যে খুচরা লেনদেনের ৭৫% এবং ২০৩১ সালের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যাশলেস অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার ল¶যাত্রা নির্ধারণ করেছে।
বর্তমানে দেশে ১১ হাজারের বেশি অনলাইন ব্যাংক শাখা, ১৩ হাজারের বেশি এটিএম বুথ, লাখা ধিক পস টার্মিনাল এবং প্রায় সাড়ে ৩ কোটির বেশি প্লাস্টিক মানি গ্রাহক রয়েছে। এছাড়াও ৬০ লাখ ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহক সক্রিয় রয়েছে (দৈনিক যুগান্তর, ২০২৪)।
এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত দ্রুতগতিতে ক্যাশলেস সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে একটি ব্যাংকের অ্যাপ থাকলেই একজন গ্রাহক সহজেই ছজ কোড স্ক্যান করে লেনদেন সম্পন্ন করতে পারছে। প্রযুক্তি, নীতিগত পরিকল্পনা এবং সর্বস্তরের অংশগ্রহণ মিলিয়ে গড়ে উঠছে একটি স্মার্ট ও ক্যাশলেস বাংলাদেশ।
ডিজিটাল অর্থ ব্যবস্থার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রবেশ করেছি এক নতুন অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর যুগে, যেখানে নগদ অর্থের স্থান দখল করেছে ডিজিটাল ট্রানজেকশন। এটি অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ করেছে, কিন্তু এর পাশাপাশি তুলে এনেছে জটিল নিরাপত্তা ও মালিকানার সংকট।
প্রযুক্তিগত ঝুঁকি ও সাইবার সুরক্ষা
ডিজিটাল লেনদেনের নিরাপত্তা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট ও কম্পিউটার সিস্টেমের উপর। হ্যাকিং, ফিশিং, র্যানসমওয়্যার এবং অন্যান্য সাইবার আক্রমণ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। আন্তর্জাতিকভাবে কোটি কোটি ডলারের আর্থিক ¶তি এসব আক্রমণের কারণে হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা অবকাঠামো এখনো পর্যাপ্ত নয়, সেখানে এই ঝুঁকি আরও বড় (দৈনিক যুগান্তর, ২০২৪)।
একই সাথে, প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা সিস্টেম ডাউন হওয়া অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণ হতে পারে, যা নগদ অর্থ ব্যবস্থার তুলনায় বেশি ¶তিকর। প্রযুক্তির উপর একচেটিয়া নির্ভরতা অর্থনীতিকে এক ধরনের ‘ডিজিটাল বন্দিত্ব’-এ পরিণত করার আশঙ্কা তৈরি করে।
মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের নৈতিক সংকট
ক্যাশলেস ব্যবস্থায় অর্থের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ অধিকাংশ সময় থাকে ব্যাংক, প্রযুক্তি সংস্থা এবং সরকারের হাতে। অর্থের ওপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। জরুরি সময়ে লেনদেন ব্লক করা, অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা বা অর্থ জব্দের মতো পরিস্থিতি মানুষকে আর্থিকভাবে অসহায় করে তুলতে পারে (বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট, ২০২৩)।
এটি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। বিশেষত গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সম্মত সমাজে এ ধরনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাজন
যদিও ক্যাশলেস অর্থনীতি উন্নত প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতার প্রতীক, এটি একটি বৈষম্যের নতুন দিকও সৃষ্টি করছে। ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় প্রবেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সা¶রতার। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও অনগ্রসর এলাকায় এসব সুবিধার অভাব অনেককে পিছিয়ে রাখছে (বাংলাদেশ অর্থনীতি পর্যালোচনা, ২০২৩)।ফলে, আধুনিক অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের ¶েত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ¶েত্রে বড়ো বাধা হিসেবে কাজ করছে।
তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা
ব্যক্তিগত আর্থিক তথ্যের নিরাপত্তা আজকের ক্যাশলেস ব্যবস্থার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তথ্যের অবৈধ ব্যবহার বা হস্ত¶েপ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার লঙ্ঘন ঘটায়। ডিজিটাল আর্থিক ডেটার বিক্রি বা অপব্যবহার সামাজিক নিয়ন্ত্রণের নতুন মাত্রা সৃষ্টি করতে পারে, যা একটি ‘সামাজিক ক্রমিক নিরীক্ষণ’ (social surveillance) ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ব্লকচেইন ও ডিভাইস (DeFi): প্রযুক্তিগত উন্নতি যেমন ব্লকচেইন ভিত্তি অর্থনীতি বা বিকেন্দ্রীকৃত অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল অর্থনীতিকে নিরাপদ করার আশা রাখে। তবে এও নতুন নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তার দিক থেকে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
ডিজিটাল ইউয়ান ও CBDC : কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) বিভিন্ন দেশের জন্য ক্যাশলেস অর্থনীতির নতুন মাইলফলক, কিন্তু এগুলো সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সংকুচিত করতে পারে।
আইনি ও নৈতিক কাঠামো : ডিজিটাল অর্থনীতির নিরাপত্তা ও মালিকানার সুর¶তার জন্য শক্তিশালী আইনি ও নৈতিক কাঠামোর বিকাশ জরুরি, যাতে প্রযুক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক ন্যায় নিশ্চিত করতে পারে।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের অর্থব্যবস্থা ছিল সরল, স্বচ্ছ ও বাস্তব সম্পদনির্ভর। সে সময়ের লেনদেন মূলত তিনটি ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছিল-স্বর্ণ, রৌপ্য এবং প্রয়োজনীয় পণ্য। মুদ্রার ¶েত্রে ব্যবহৃত হতো দীনার ও দিরহাম। দীনার ছিল খাঁটি স্বর্ণমুদ্রা, যা মূলত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে আরব ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। অন্যদিকে দিরহাম ছিল রৌপ্যমুদ্রা, যার প্রচলন শুরু হয়েছিল পারস্যের সাসানীয় প্রভাবে। এই মুদ্রাগুলোর কোনো কাগুজে প্রতিশ্রুতি ছিল না, বরং প্রতিটি মুদ্রার প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হতো তার ওজনভিত্তিক খাঁটি ধাতুর মানের ওপর। ফলে এতে জালিয়াতি, মূল্যহীন মুদ্রা বা কৃত্রিম মুদ্রাস্ফীতির কোনো সুযোগ ছিল না।
তবে মুদ্রার অভাব বা সুবিধাজনক লেনদেনের প্রয়োজনে অনেক সময় পণ্য বিনিময় প্রথাও ব্যবহৃত হতো। খেজুর, যব, গম, লবণ, বস্ত্র ইত্যাদি ছিল সাধারণ মানুষের মূলধন ও লেনদেনের উপকরণ। সাহাবায়ে কেরাম রাযি.হাদীসে উল্লেখ করেছেন, তাঁরা অনেক সময় খেজুর বা খাদ্যশস্যের বিনিময়ে শ্রম দিতেন কিংবা মজুরি গ্রহণ করতেন। যেমন, এক সাহাবী বলেন-“আমরা নবিজির যুগে খেজুরের বদলে খেজুরের শ্রমিক ভাড়া করতাম।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮৫)
তৎকালীন সমাজে আরেকটি ন্যায্য ও মানবিক লেনদেন পদ্ধতি ছিল ‘সালাম’ বা ‘সালাফ’, যা ছিল আগাম চুক্তিভিত্তিক। এই ব্যবস্থায় ক্রেতা আগেই মূল্য প্রদান করতেন এবং নির্ধারিত সময় পর বিক্রেতা পণ্য সরবরাহ করতেন। এটি বিশেষভাবে উপকারী ছিল কৃষকদের জন্য-কারণ তারা ফসল তোলার আগেই আর্থিক সহায়তা পেতেন, আর চাষাবাদ শেষে প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ করতেন।
নববী যুগের দিনার ও দিরহাম : নিরাপত্তার এক পরিপূর্ণ প্রতিরূপনবীজীﷺ-এর যুগে প্রচলিত দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) ছিল এমন এক অর্থব্যবস্থার প্রতীক, যা বাস্তব সম্পদ নির্ভর তা, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার এক সুসংহত কাঠামো গঠন করেছিল। এই মুদ্রাগুলোর ছিল নিজস্ব অন্তর্নিহিত মূল্য -প্রতিটি দিনারে থাকত প্রায় ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ, আর এক দিরহামে প্রায় ৩ গ্রাম রৌপ্য। স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিজস্ব বৈশ্বিক মূল্য থাকায় এ ধরনের মুদ্রা কখনোই একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়ত না (ঐধসরফঁষষধয, ১৯৯৭)।
বাস্তব সম্পদনির্ভর মুদ্রা: মুদ্রাস্ফীতি ও জালিয়াতি থেকে মুক্তএই মুদ্রা সরাসরি প্রকৃত ধাতুতে গঠিত হওয়ায়, তা কৃত্রিমভাবে ‘তৈরি’ করার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে সরকারের বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারী মুদ্রা ছাপানোর আশঙ্কাও ছিল না, যা স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি হ্রাস করত। তদুপরি, ওজন নির্ভর ও যাচাইযোগ্য ধাতু হওয়ায়, প্রতারণা বা জালিয়াতির সুযোগও ছিল সীমিত (অষ-গধয়ৎরুর, ১৪ঃয পবহঃঁৎু)। এর ফলে ব্যক্তি তার সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারত, এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হতো ন্যায়নিষ্ঠ ও আস্থাভাজন।
আধুনিক ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা: অদৃশ্য ঝুঁকির এক জটিল পরিসর আধুনিক ক্যাশলেস অর্থব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে টাকা একটি বাস্তব বস্তু নয়, বরং একগুচ্ছ ইলেকট্রনিক সংকেতমাত্র। এর মালিকানা থাকে ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। ব্যক্তি যতটুকু অর্থ ব্যবহারে স¶ম, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস ও ডিজিটাল অ্যাকসেসের উপর। ফলে একদিকে এটি যেমন দ্রুত ও সুবিধাজনক, অন্যদিকে এটি জর্জরিত হয় সাইবার ঝুঁকি, হ্যাকিং, এবং প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের মতো অনিশ্চয়তায়।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে সাইবার অপরাধের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক ¶তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । অপরদিকে, ডিজিটাল মুদ্রার ¶সূত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে মাত্র একটি বোতাম চাপার মাধ্যমে কারো অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিতে পারে, যা ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য এক গুরুতর হুমকি।
ফিয়াট মানির ভিত্তিহীনতা ও অবিশ্বস্ততাআধুনিক কাগুজে ও ডিজিটাল মুদ্রার নিজস্ব কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য নেই। এটি পুরোপুরি রাষ্ট্রের ঘোষণার উপর নির্ভরশীল। তাই সংকটময় পরিস্থিতিতে, যখন জনগণের রাষ্ট্রের উপর আস্থা কমে যায়, তখন মুদ্রার মানও দ্রুত হ্রাস পায়। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, কৃত্রিম মুদ্রানীতির কারণে অর্থনৈতিক মন্দা বা ধ্বংস নেমে এসেছে । অপরদিকে, নববী যুগের অর্থনীতি স্বর্ণ ও রৌপ্যের মতো দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে ওঠায় এ ধরনের পতনের সম্ভাবনা ছিল না।
নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা : ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূল চেতনাইসলামী অর্থব্যবস্থা মাত্র লাভ বা লেনদেনের মাধ্যম নয়; এটি একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কাঠামোর অংশ। এখানে সম্পদ ধরা হয় এক ধরনের আমানত, যার ব্যয় ও ব্যবহার আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ও ন্যায়ের আলোকে নির্ধারিত (আল-কুরআন, সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন, আয়াত ১-৩)। এই দৃষ্টিভঙ্গিই নববী অর্থব্যবস্থাকে কেবল একটি অর্থনৈতিক প্রস্তাব নয়, বরং একটি সামাজিক ন্যায়ের ঘোষণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কোন পথে যাবে মানবসভ্যতা?এই পরিবর্তন কেবল অর্থনীতির নয়-বরং ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিশ্বাস ও ন্যায়বোধের মৌলিক প্রশ্নও উত্থাপন করে। অর্থ কেবল লেনদেনের মাধ্যম নয়; এটি নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক। যদি সেই আস্থার ভিত্তি হয় অদৃশ্য, কেন্দ্রীভূত ও নিয়ন্ত্রণাধীন, তবে মানবসভ্যতা কতদিন এই কাঠামোর উপর টিকে থাকতে পারবে?
আমরা কি শুধুই প্রযুক্তির আরাম ও গতি কিনে নিচ্ছি-নাকি আসলে এক নিরাপদ, ন্যায়নিষ্ঠ ও আল্লাহর সীমা নির্ধারিত বাস্তব কাঠামো ভুলে গিয়ে নিজেদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? এই প্রশ্ন প্রতিটি সচেতন মানুষের কাছে আজ অত্যন্ত জরুরি।
লেখক- শিক্ষক আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।