
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল এলাকার ২৫ বছর বয়সী যুবক রনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসারের হাল ধরেছিলেন। তার উপার্জনেই চলত পরিবারের ভরণপোষণ। হাসি-খুশিতে ভরা সংসার হঠাৎ ভেঙে গেল এক মোবাইল অ্যাপের প্রলোভনে।
প্রথমে বিনিয়োগ করে কিছু লাভ পান রনি। কিন্তু সেই লাভই তাকে আরও আসক্ত করে তোলে। ধীরে ধীরে জীবনের সব সঞ্চয়, ব্যবসার পুঁজি ঢেলে দেন অনলাইন জুয়ায়। একসময় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। পরিবারকে আবার নতুন করে দাঁড় করানোর আশায় ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিলেও সেই টাকাও চলে যায় অনলাইন জুয়ার খপ্পরে। শেষমেষ দিশেহারা হয়ে বিষপানে নিজের জীবনের ইতি টানেন তিনি। নিঃস্ব হলো তার পরিবারও।
প্রতিবেদনের কাজে নুরুল কবির নামে আরও এক যুবকের সন্ধান মেলে। সিএনজি চালক নুরুল কবির সুখী পরিবার নিয়ে ভালোই ছিলেন। কিন্তু বন্ধুর প্ররোচনায় তিনি অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। উত্তেজনার নেশায় একের পর এক বাজি ধরতে গিয়ে হারাতে থাকেন সঞ্চয় ও সংসারের শান্তি।
শুধু রনি কিংবা নুরুল নয়। এই অনলাইন জুয়ায় প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে শত শত যুবক। সারাদেশে প্রতিনিয়ত এই জুয়ায় নিজেদের সবকিছু হারিয়ে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, ন্যাশনাল ভায়োলেন্ট ডেথ রিপোর্টিং সিস্টেম-এর ডেটায় ১৩০৬টি কেস চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলোতে গবেষকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে জুয়া ছিল আত্মহত্যার সাথে একটি অর্থপূর্ণ ফ্যাক্টর (এটি সম্ভবত নির্দিষ্ট দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) রেকর্ড-ভিত্তিক বিশ্লেষণ)।
এই অনলাইন জুয়া ভয়াবহ রূপ নিয়ে চট্টগ্রামেও। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা যায় , চট্টগ্রামেও জুয়ার ফাঁদে পড়ে আত্মহত্যা কিংবা ধ্বংসের সংখ্যাও কম নয়।
অনলাইন জুয়া এখন আর শুধু তাস বা ক্যাসিনোতে সীমাবদ্ধ নয়। মোবাইল অ্যাপে খেলা হচ্ছে ক্রিকেট, ফুটবল, তিন পাত্তি, রামি, রঙের খেলা, এভিয়েটর গেম, আইপিএল বেটিং— এমনকি জনপ্রিয় লুডুও পরিণত হয়েছে জুয়ার আসরে। শুরুতে মজা করার জন্য খেলতে নামলেও, শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ আসক্তিতে ডুবে যাচ্ছেন অনেক তরুণ।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে চায়ের দোকান, বিভিন্ন ক্লাব আড়ালে বসছে এসব জুয়ার আসর। বাইরে সাধারণ ব্যবসা মনে হলেও ভেতরে চলছে হাজার হাজার টাকার বাজি। দুপুরে আড্ডার নামে, রাতে দোকান বন্ধের পরেও মোবাইলের পর্দায় চোখ রেখে চলতে থাকে বাজি।
এক আসক্ত যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—“প্রথমে বন্ধুদের দেখাদেখি লুডু খেলতে শুরু করি। ৫০ টাকা দিয়ে শুরু হলেও পরে তা একসময় হাজার টাকার ওপরে চলে যায়। জিতলে ভালো লাগত, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই হারতাম। ঋণ করতে করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা দেনায় জড়িয়ে গেছি। এখন চাকরি নেই, ঋণের চাপে ঘুম হারাম হয়ে গেছে।”
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবারগুলো। সংসারে শান্তি নেই, দাম্পত্য সম্পর্কে ভাঙন ধরছে, ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। সন্তানরা পড়াশোনা ছেড়ে মোবাইলে বাজির অপেক্ষায় থাকে। যুবকরা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আসক্তি ও টাকা হারানোর চাপ থেকে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেসবুক-ইউটিউবে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণদের জুয়ার প্রতি আকৃষ্ট করা হচ্ছে। কোথাও শর্টফিল্মে, কোথাও জনপ্রিয় গানের রিমেক ভিডিওতে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন। কোটি ভিউয়ের মাধ্যমে এসব বিজ্ঞাপন তরুণদের টেনে নিচ্ছে আসক্তির অন্ধকারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক প্রকাশ চন্দ্র রায় বলেছেন, বর্তমানে অনলাইন জুয়া বা গ্যাম্বলিং ভয়াবহ সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত আসক্তি নয়, বরং ব্যাপক সামাজিক সমস্যা যা আর্থিক অস্থিরতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ ও অপরাধের চক্র তৈরি করছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফিন্যান্সের সহজলভ্যতা এই অপরাধকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। যুবকরা দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে পড়ে গভীর আসক্তিতে ডুবে যাচ্ছে, ফলে আর্থিক ক্ষতি, সম্পর্ক ভাঙন, মানসিক অবসাদ এমনকি আত্মহত্যার ঝুঁকিও বাড়ছে। গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাম্বলিং ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা ২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, এই সমস্যার প্রতিরোধে সরকার, সমাজ, পরিবার এবং ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্যের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ,ডোমেইন ব্লকিং ও আইনি ব্যবস্থা; মানসিক স্বাস্থ্য হেল্পলাইন চালু; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক ক্লাস; মিডিয়া প্রচারণা; পরিবারিক পর্যায়ে অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ; কাউন্সেলিং সেন্টার ও থেরাপি গ্রুপ চালু করা এবং যুবকদের বিকল্প কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।
এই অনলাইন জুয়ার বন্ধে চট্টগ্রামে প্রশাসনের তৎপরতা কি জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের এডিসি পিআর শ্রীমা চাকমা বলেন – “অনলাইন জুয়াখেলা এবং অনলাইনের বিভিন্ন এজেন্টদের কার্যক্রম বন্ধে আমাদের সাইবার পেট্রোলিং টিমের নজরদারি আছে। অনলাইন জুয়ার লেনদেনে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসর জন্য থানাসমূহের কার্যক্রমও চলমান আছে।”
এআরই/দেশবিদেশ