হারিয়ে যাচ্ছে সখীপুরের সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ‘মান্দাই’ আদিবাসী





শেয়ার

preview

সেলিনা জাহান প্রিয়াঃ- টাঙ্গাইলের সখীপুর লালমাটি আর সবুজ বনবনানীতে ঘেরা। এখানে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘মান্দাই’ নামক স্বতন্দ্র আদিবাসী গোষ্ঠী বাস করে। ঐতিহ্যগত দিক থেকে এরা এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। এদের রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার। রয়েছে নিজস্ব ভাষা, কৃত্য ও ধর্মাচরণ। দৈহিক গঠনগত দিকে থেকেও এরা বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক। পূঁজার্চনাসহ বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এরা পালন করে নিজস্ব রীতিতে। বাংলাদেশে জাতিগত বৈচিত্রে এরা মূল্যবান অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু কালের চক্রে সমৃদ্ধ এই আদিবাসী গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন প্রায়। আজ তাঁরা স্থানীয় প্রভাবশালী অপরাপর নাগরিকদের দ্বারা নিগৃহীত, নিষ্পেষিত। তাদের জমি ভিটেমাটি জোর করে দখল করা হয়েছে এখনও হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দেশ ছাড়ছেন অনেকেই। যারা আছেন নিতান্তই মাটির টানে, ভাত জোটেনা তাদের। যে জমি তাদের অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করতো সেই নিজের জমিতেই এখন তারা দিন মজুরি খাটেন। তারপরও প্রতিনিয়তই নানা হুমকি ধামকির মধ্যে তাদেরকে বসবাস করতে হয়। তারা মনে করছেন, এদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় সংখ্যায় তারা কম তাই তাদের আইনগত অধিকার সংরতি হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কালিদাস, কচুয়া, নলুয়া, বড়চওনা, ধোপারচালা, নয়াপাড়া, আন্দি, ঠকাইনা, ফুলঝুরি, বড়চালা, আমতৈল, বাজাইল, বাইটক্যা, দেউবাড়ী, দেবলচালা, দেওদিঘী প্রভৃতি অঞ্চলে মান্দাই নামক আদিবাসী গোষ্ঠী বাস করে। বাংলাদেশে বসবাসরত মান্দাই আদিবাসী গোষ্ঠীর জনসংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি।মান্দাই আদিবাসী গোষ্ঠীরা শিবের পুত্র ত্রিয়গোত্রজাত। একবার কোনও কারণে এ আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে মহাভারতোক্ত পরশুরামের সংঘর্ষ বাঁধে। ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধে মান্দাইরা পরাজিত হয়। এরপর প্রতিপরা মান্দাইদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। আর তাই এ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সময় মান্দাইরা নিজেদের অস্তিত্ব রাকল্পে গোত্র প্রধানের নির্দেশে তাদের ‘নগুণ’ অর্থাৎ ত্রিয় সূত্র খুলে শ্যাওড়া গাছে লুকিয়ে রেখে পালায়। সেই থেকে এদেরকে অন্যান্যরা ‘মান’ (সম্মান) ‘দেয়’ (বিসর্জন দেয়) অর্থে ‘মান্দাই’ অভিধায় চিহ্নিত করে। তবে মান্দাইরা যে ‘ঠার’ ভাষায় কথা বলে তাতে সম্মান অর্থে ‘মান’ এবং দেওয়া অর্থে ‘দাই’ বরং মান্দাইদের ভাষায় ‘মেন্দাই’-এর অর্থ মানুষ। কাজেই ‘মেন্দাই’ থেকে ‘মান্দাই’ নামের উৎপত্তি এমত সিদ্ধান্ত নেওয়াই যৌক্তিক। এছাড়া মান্দাই আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকজন তাদের নামের শেষে ‘কোচ’ উপাধি ব্যবহার করে। সেজন্য ধারণা করা যায় যে, এরা কোচ আদিবাসী গোষ্ঠীরই একটি অংশ। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, কোচগণ হিমালয় পর্বতের পাদদেশে পৌরাণিক নগরের অধিবাসী ছিলেন। আবার কোচগণের আদি নিবাস কোচ বিহার বলেও কথিত আছে। সেখান থেকে পরে এরা ব্রহ্মপুত্র নদের দণি তীরে দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করে পূর্ববঙ্গে উপণীত হয়। একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাদেশে কোচগণ গোড়া পত্তন করেন। টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী অংশে মান্দাই রাজবাড়ি ছিল বলে এ আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকজন তথ্য দেন। এদেশে আসার পর তাদের পূর্ব পুরুষদের একাংশ পাহারাদার, চৌকিদার প্রভৃতি দেহরীর কাজ করত। অন্যরা বনের পশু শিকার, মৎস্য শিকার, কাঠ বাঁশজাত দ্রব্যাদি তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে এদের অধিাকংশই কৃষিজীবি। মান্দাইরা পিতৃতান্ত্রিক। তবে এদের সংসার জীবনে এবং কর্মেক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাজ করে। খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কে এদের নিজস্ব রীতি আছে। এরা সাধারণত ভাত, ডাল, মাছ, মাংস ও শাক-সবজি খেয়ে থাকে। পশুর মাংসের মধ্যে ক”ছপ, কুইচা, খরগোশ, হাঁস, মোরগী, পাঠা, খাসি, ভেড়া, হরিণ ও শুকরের মাংস এদের কাছে বেশি প্রিয়। পানীয়ের ক্ষেত্রে এরা নিজেদের তৈরি চুলাই মদ্যপানে অভ্যস্ত। যে কোন আচার অনুষ্ঠানে মদ এদের চাই-ই চাই। এদের ভাষায় মদকে বলা হয় ‘দরা’। এরা মদ্যপ জাতি নয়। মদপান এদের কৃত্যের অংশ। কৃষি কাজে লাঙল, দা, কাঁচি, শাবল ইত্যাদি সাধারণ যন্ত্রপাতি ছাড়া এরা কোন উন্নত ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না। পোশাক-পরিচ্ছেদের ত্রে মান্দাই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বাঙালী জনগোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত। বাঙালী পুরুষ ও রমণীর মতোই এরা বর্তমানে আটপৌরে পোশাক পরিধান করে। পুরুষরা শার্ট, গেঞ্জি, লুঙ্গি, ধূতি, প্যান্ট এবং মেয়েরা সাধারণত শাড়ি, ব্লাউজ পরে থাকে। তবে কোচ রমণীরা পূর্বে কোমর থেকে হাঁটুর নিচে গোড়ালী পর্যন্ত এবং উপরিভাগে বগল থেকে কোমর পর্যন্ত কাপড় পরিধান করে ওড়নার ন্যায় ব্যবহার করত। মান্দাই সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক শির হার নেই বললেই চলে। অধিকাংশ মান্দাই-ই অশিতি। এদের মধ্যে হাতে গোনা অল্প কিছু সংখ্যক লোক শিক্ষিত হলেও বাকীরা স্বার জ্ঞান সম্পন্ন। আদিম অবস্থায় প্রত্যেক গোষ্ঠীরই তা যতই ছোট হোক না কেন,তাদের নিজস্ব ভাষা বা উপভাষা আছে। কিন্তু মান্দাইদের মৌখিক ভাষারীতি থাকলেও তার কোন লেখ্য রূপ নেই। তাছাড়া “ঠার’ ভাষা নামে পরিচিত তাদের নিজস্ব ভাষার চর্চায় তারা আগ্রহী নয়। কেন না তাতে প্রতিবেশি বাঙালী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এ অবস্থার কারণে মান্দাই আদিবাসী গোষ্ঠীর পৃথক কোন শিল্পরীতি গড়ে ওঠেনি। তাই এদের শিল্প-সাহিত্য চিন্তাও আদিম সমাজের মতো কৃত্য তথা ধর্মাচার সংশ্লিষ্ট। কৃষি প্রধান সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়ানুষ্টানের ব্যাপকতার মাঝেই এদের শিল্প চিন্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। পুরুষের পাশাপশি মান্দাই নারীরাও মাঠে কাজ করে। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই।বাল্য বিবাহের করাল গ্রাস থেকেও এরা মুক্ত নয়। তার ওপর বিয়েতে রয়েছে যৌতুক প্রথা। এদের মধ্যে বিধবার পুনঃবিবাহ রীতি নেই। নানা রীতি এবং কু-সংস্কারের যাতাকলে পিষ্ট এরা। শুভ-অশুভ শক্তির দ্বৈত মিশ্রণে তাঁরা জীবন যাপন করে। তবে তাঁরা ধর্মীয়চিন্তা গঠনে ব্যক্তি অস্তিত্বের চেয়ে সামাজিক অস্তিত্বই অধিকতর ক্রিয়াশীল। এ আদিবাসী গোষ্ঠীর ধর্মচিন্তা সংবলিত কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। তাদের ব্যবহৃত ‘ঠার’ ভাষার কোন লিখিত বর্ণমালা না থাকায় তাদের ধর্মাচারের শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক দিকগুলোর সংরক্ষণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে তাদের ধর্মচিন্তা সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এরা সারা বছর ধরেই বিভিন্ন পূজাপার্বন পালন করে থাকে।বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক ড. হারুন রশীদ এই আদিবাসী গোষ্ঠীর কৃত্য ও নাটক নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতিগত ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে মান্দাই আদিবাসী গোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য এদের ভাষা, কৃষ্টিকালচার যাতে রা পায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিতি করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই হয়তো এদের অবলুপ্তি ঠেকানো যাবে। উপজেলার বড়চওনা গ্রামের কলেজ শিক অনিল চন্দ্র বর্মণ বলেন, মান্দাইদের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক থাকার পরও তাদের শিশুরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ মান্দাই জনগোষ্ঠীর লোকজন এতোই দরিদ্র যে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সামান্য সামর্থটুকু তাদের নেই। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানান তিনি।তাঁরা মনে করছেন, ক্ষয় আর ধ্বংসের মুখে কোন আদিবাসী গোষ্ঠীর নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। সুতরাং মৃত কোন গাঙের নামের মতোই একদিন শুধু ওদের নামটুকু থাকবে। ওরা অন্তর্হিত হবে সূর্যালোক সম্পাতে উদ্ভাসিত ভুবনের সকল দৃশ্যমালা থেকে।

লাইফস্টাইল


শেয়ার