পদ্মা বহুমুখী সেতুর দ্বার খুলছে আজ।





শেয়ার

অপেক্ষার প্রহর শেষ। স্বপ্ন হলো সত্যি। প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড় ছুঁয়ে বুক উঁচিয়ে দাঁড়ানো পদ্মা বহুমুখী সেতুর দ্বার খুলছে আজ। দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের স্বপ্নদুয়ার এই সেতু পুরো দেশের এক গর্বের ইতিহাস। পুরো বিশ্বের বিস্ময়। খরস্রোতা পদ্মার স্রোতকে হার মানিয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের বাংলাবাজারকে যুক্ত করা এই সেতু দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ আর বাণিজ্যের নতুন দিনের এক বার্তাবহ। পদ্মা জয়ের উৎসব আজ ছুঁয়ে যাবে সারা দেশ। পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে  সারা দেশে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। পদ্মাপাড়ে সাজ সাজ রব। নতুন দিনের আনন্দে মুখর দক্ষিণের মানুষ।

বিজ্ঞাপন  

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈঘ্যের পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এই অর্থ সংস্থান হয়েছে সরকারি কোষাগার থেকে। নিজস্ব অর্থায়নের এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশ নিজেদের সক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরেছে। নদীর স্রোত, গভীরতা ও নদীর তলদেশের গঠন অনুসারে পদ্মা সেতু বিশ্বের স্থাপত্য ইতিহাসের এক বিস্ময়। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেতু বাস্তবায়ন খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।

 

 কিন্তু এই অসাধ্য কাজটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে লক্ষ্য অনুযায়ী শেষ হয়েছে সেতুর নির্মাণকাজ। পদ্মা সেতু এখন পুরো জাতির গর্ব। সক্ষমতার এক বড় বিজ্ঞাপন। এই সেতু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী সংযোজন।  মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টে আজ সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম এবং বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করবেন। সকাল ১১টা ১২ মিনিটে মাওয়া পয়েন্টে টোল পরিশোধের পর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল ১১টা ২৩ মিনিটে মাওয়া পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী যাত্রা শুরু করবেন। সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে জাজিরা পয়েন্টে সেতু ও ম্যুরাল-২ এর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। বেলা ১২টায় মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত দলের জনসভায় যোগ দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।  ২০১৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সেতু অংশ দৃশ্যমান হয়। 

পরে একের পর এক ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সরকারের সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধানে মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদী শাসন করেছে চীনের সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন। মোট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। ১৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদী শাসন কাজে ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। টোল প্লাজা এবং এসএ-২সহ ১২ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোডের নির্মাণ ব্যয় ১,৯০৭ কোটি টাকা, ২টি থানা ভবন এবং ৩টি পরিষেবা এলাকাসহ পুনর্বাসনের ব্যয় হয়েছে ১,৫১৫ কোটি টাকা। এছাড়া জমি অধিগ্রহণে ২,৬৯৩ কোটি টাকা, পরিবেশ রক্ষায় ১,২৯০ কোটি টাকা, কনসালটেন্সিতে ৬,৭৮৩ কোটি টাকা এবং অন্যান্য (বেতন, পরিবহন, সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স, ফিজিক্যাল এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি, ইন্টারেস্ট ইত্যাদি) ১,৭৩১ টাকা ব্যয় হয়েছে এই সেতু প্রকল্পে। ২০১৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলার জাজিরা পয়েন্টে নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন।  ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর বর্তমান ডিজাইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। পরের বছর জানুয়ারিতে, ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫শ’ ৭ কোটি টাকা। 

 

 

খরচ বাড়ার পেছনে বেশকিছু কারণ ছিল। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার যা পরবর্তীতে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারে উন্নীত হয়। প্রথম ডিপিপিতে, সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচে নৌযান চলাচলের জন্য জায়গা রেখে নকশা তৈরি করা হয়েছিল। পরে, ডিপিপি সংশোধন করার মাধ্যমে ৩৭টি স্প্যানের নিচে জাহাজ চলাচলের সুযোগ রাখা হয়। সংশোধিত ডিপিপিতে অনেক ওজন বহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয়েছে। কংক্রিটের পরিবর্তে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে খরচ বাড়ানো হলে মূল সেতু নির্মাণ ও নদী শাসনসহ সব কাজে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। পদ্মা বহুমুখী সেতু ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে টোল ঘোষণা করেছে সরকার।  নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা পুরো এলাকা: প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয়েছে শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট ও ঘাটের আশেপাশে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। সভাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে সেনাবাহিনী, র‍্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি।

 দিন গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত জনসভাস্থলে ও আশেপাশে তাদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এদিকে শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট, ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেস ওয়ের শিবচর ও জাজিরা এলাকায় র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতি ১০ গজ পর পুলিশ, র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে সকাল থেকেই আকাশে হেলিকপ্টারের মহড়া দিতেও দেখা গেছে। এদিকে সকাল থেকেই বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল টিমের গাড়ি দেখা গেছে। এছাড়াও সকাল ১০টার দিকে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বেলা ১১টার দিকে পুলিশের মহা পরিদর্শক বেনজির আহমেদ, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বাংলাবাজার ফেরিঘাটে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল পরিদর্শনে আসেন।  যেভাবে পদ্মা সেতুর সূচনা: প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিতে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার জন্য ছিল সীমাহীন কষ্ট। প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে প্রায় ঘটতো দুর্ঘটনা। কত মানুষের জীবন নিয়েছে এই পদ্মা তার কোনো হিসাব নেই। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে সেতু তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ১৯৯৮ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। চলে ২০০০ সাল পর্যন্ত। 

২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় আবার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরপর ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৭ সালে একনেক সভায় ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প অনুমোদন পায়। তখন মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। সেতুর নকশা প্রণয়নে ২০০৮ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হয়। পরে সেতুর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার হয়।  নির্মাণযজ্ঞ: ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে ৩ হাজার ২০০ টন ওজনের স্প্যান বসানো শুরু হয়। সেই থেকে তিন বছর দুই মাস ১০ দিনে বা মোট ১১৬৭ দিন পর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর সবশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। ২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর দৃশ্যমান হয় সেতুর পুরো ৬ হাজার ১৫০ মিটার। এরপর শুরু হয় সড়ক স্ল্যাব বসানোর কাজ। ২০২১ সালের ২৩শে আগস্ট সর্বশেষ সড়ক স্ল্যাব বসানো হয়। চলতি বছরে শুরু হয় সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ। 

একইসঙ্গে চলে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও। গত ১৪ই জুন সন্ধ্যায় সবগুলো বাতি জ্বালানোর মধ্য দিয়ে পুরো পদ্মা সেতু আলোকিত হয়। ওইদিন প্রথম একসঙ্গে জ্বলে ওঠে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুতে থাকা ৪১৫টি বাতি। এরমধ্য দিয়ে দুই প্রান্তসহ মাঝ পদ্মায়ও আলোয় ঝলমলে করে ওঠে পদ্মা সেতু। সেতুতে থাকা ১৭৫ ওয়াটের প্রতিটি এলইডি লাইটের একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব সাড়ে ৩৭ মিটার। সহ্য করতে পারবে ঘণ্টায় ২শ’ কিলোমিটার বাতাসের গতি। মূল সেতুতে ৩২৮টি এবং দুই প্রান্তের সংযোগ সেতুতে ৮৭টি লাইট রয়েছে। তবে চোখ ধাঁধানো পদ্মা সেতুর আর্কিটেকচারাল লাইটটি স্থাপন হবে উদ্বোধনের পর। গভীরতম পাইল: পদ্মা নদী এতই খরস্রোতা যে আমাজন নদীর পরই পদ্মা নদীর অবস্থান। ভরা বর্ষায় পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে চার থেকে সাড়ে চার মিটার। সাধারণত পাহাড়ি নদীতে স্রোত বেশি থাকে। কিন্তু সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগের অবস্থানে এত স্রোত পদ্মার মতো অন্য কোথাও তেমন দেখা যায় না। যা একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার নদী আমাজনেই দেখা যায়। এমন নদীর উপর সেতু নির্মাণে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে নির্মাতাদের। 

মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি। যা পৃথিবীতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। পাইলিংয়ের সময় নদীর তলদেশে নরম মাটি শক্ত করতে স্কিন গ্রাউটিং করা হয়েছে। এ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ ধরনের অতি মিহি সিমেন্ট। এতে পাইলের ওজন বহনক্ষমতা বাড়ে। পিলার ও স্টিলের কাঠামোর সংযোগস্থলে ভারী বিয়ারিং বসানো হয়েছে। সাধারণত সেতুতে দুটি করে বিয়ারিং বসানো হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুই স্প্যানের সংযোগ স্থলে তিনটি করে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। তবে প্রথম দিকে সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পরে সমস্যা দেখা যায়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করেন। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের এই পদ্ধতিতেই বসানো হয় পদ্মা সেতু। এ প্রক্রিয়ায় উপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়। তারপর ওই মাটিতে পিলার গেঁথে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েল্ডিং করে দেয়া হয়। পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। কেমিক্যালের প্রভাবে তখন তলদেশের সেই মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। একপর্যায়ে সেই মাটি পাইলের লোড বহনে সক্ষম হয়ে ওঠে। তখন আর পাইল বসাতে কোনো বাধা থাকে না। সেতুর ধারণ ক্ষমতা: ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রেখেইে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। 

অর্থাৎ এটি প্রায় ১০ হাজার টন লোড সামলাতে সক্ষম। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় মাটির যে কম্পন, তার সবটা যেন সেতুর উপরি কাঠামোয় যেতে না পারে, তার জন্য ব্যবহার করা হয় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এটি ব্যবহার করলে ভূমিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতুর কাঠামোয় এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না। একেকটি বিয়ারিংয়ের ওজন ১০ হাজার ৫০০ টন।  বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার: পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় সেতুগুলোতে ব্যবহার করতে হয়নি। পদ্মায় যে ক্রেনটি ব্যবহৃত করে পিলারের উপর স্প্যান বসানো হয়েছে সেটি চীন থেকে ভাড়া আনা হয়েছে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে শুধুমাত্র ক্রেনেই খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।  কংক্রিট ও স্টিলের ব্যবহার: পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। এখন পর্যন্ত বিশ্বে বড় বড় যে সেতুগুলো নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো হয়তো কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলের তৈরি। পদ্মা সেতুর স্থায়িত্বকাল কত: সেতু বিভাগ বলছে এটি বিশ্বের ‘মোস্ট কমপ্লেক্স সেতু’।

 এটির স্থায়িত্বকাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান মাহমুদ আমানতের মতে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে পদ্মা সেতুর নকশা ও নির্মাণকাজ করা হয়েছে। যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এই সেতুর স্থায়িত্ব ১০০ বছরের বেশি হবে।  প্রতিদিন কত গাড়ি চলবে: আগামীকাল সকাল থেকেই সেতুতে যান চলাচল উন্মুক্ত হবে। ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ২১ জেলায় মানুষ যাতায়াত করবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন গড়ে দৈনিক ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে এই সেতু দিয়ে।  যা আছে পদ্মা সেতুতে: পদ্মা সেতুর ধরন দ্বিতলবিশিষ্ট। এর প্রস্থ ৭২ ফুট। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির উপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হচ্ছে স্প্যানের মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা। পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটর, ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। গাড়ি না থামিয়ে টোল আদায়: টোল ব্যবস্থাপনা, সফটওয়ারসহ আধুনিক সব ব্যবস্থা নিয়ে আসছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন। টোল দিতে পদ্মা সেতুতে গাড়ি থামাতে হবে না। 

কারণ টোল বুথ পার হওয়ার সময়ে গাড়ির স্টিকার স্ক্যান করে টাকা কেটে নেয়া হবে টাচ ফ্রি বা ইলেক্ট্রনিক টোল কালেকশন সিস্টেমে। তবে পাশাপাশি থাকছে কার্ডে টাকা দেয়ার সুবিধা, রাখা হচ্ছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিও। তবে প্রথম দিকে একটি বুথে এ সিস্টেম চালু করা হবে। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী এর সংখ্যা বাড়তে পারে।  যাদের প্রচেষ্টায় তৈরি পদ্মা সেতু: সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। শুরু থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের পেছনে ছিলেন বাংলাদেশ, চীন ও ইউরোপের প্রায় ১২০০ প্রকৌশলী ২০ হাজার শ্রমিক। জার্মানি থেকে হ্যামার, লুক্সেমবার্গ থেকে রেলের স্ট্রিংগার, চীন থেকে ট্রাস, অস্ট্রেলিয়া থেকে পরামর্শক; এমনিভাবে দেশ-বিদেশের প্রযুক্তি, মেধা ও শ্রমে পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে উদ্বোধন হচ্ছে।

 

জাতীয়


শেয়ার