সংসার আর চলে না





শেয়ার

বাদাম বিক্রেতা আশিক মিয়া। থাকেন রাজধানীর লালবাগে। ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বিক্রি। এতে ৪০০-৫০০ টাকা আয় করেন। গত ২০ বছর ধরে এটাকে পেশা ধরে এগিয়ে গেছেন। সংসারে তার পাঁচ সদস্য। সবার দেখভালের দায়িত্ব তার। ৩-৪ বছর আগেও তার এই আয়ে মোটামুটি সংসার চলতো। তবে এখন সংসারে টানাপড়েন চলছে।

বিজ্ঞাপন  

কারণ এখন ব্যয়ের সঙ্গে তার আয়ের হিসাবে বড় গরমিল হয়। আশিক বলেন, আগে ৪০০ টাকাতেও সংসার চলতো। এহন ৫০০ টাকাতেও চালাতে পারি না। ঘরভাড়া বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ডাল ভাত খাইয়া বাইচা আছি। 

 

স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে আশিক থাকেন এক রুমের একটি বাড়িতে। বাড়িটির ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ঘরের চৌকিতে আশিকের তিন সন্তান ঘুমায়। আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি মেঝেতে বিছানা করে ঘুমান। চাইলেও বেশি ভাড়া দিয়ে দুই রুমের একটি ঘর ভাড়া নিতে পারেন না। যেখানে ডাল ভাত খেয়েই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে বেশি ভাড়া দিয়ে ঘর নেয়া নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আশিক জানান, গত দুই বছরে শুধুমাত্র কোরবানি ঈদ ছাড়া তারা গরুর মাংস কিনে খেতে পারেননি। এবার ঈদে বাড়ির মালিক কিছু গরুর মাংস দিয়েছে তাই ঈদের দিন রান্না করে খেয়েছেন। ডাল, আলু ভর্তা আর শাক তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী।

রনি চন্দ্র দাস সকাল ৭টায় সড়কের পাশে জুতা সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসেন। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করেন। কিন্তু তার নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। কোনোদিন ২০০ টাকা আবার কোনোদিন ৩০০-৪০০ টাকা আয়। এতেই চলে তার সংসার। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে রনির ৪ জনের সংসার। বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। ছোট ছেলের বয়স ৪। তাদের নিয়ে আড়াই হাজার টাকা ভাড়ার একটি ছোট টিনশেড ঘরে থাকেন। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে রনিকে প্রতিনিয়ত সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, এহন ভালো কিছু কিনে খাইতে পারি না। কোনোদিন ভালো আয় হইলে মাছ কিনতে পারি নইলে পারি না। সপ্তাহে একদিন মাছ খাওয়া হয়। সব সময় ডাল, আলু দিয়া খাই।

আশিক-রনির মতো নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষ কষ্টে আছেন। ‘মূল্যস্ফীতির খাদ’ যতই গভীর হচ্ছে তাদের যন্ত্রণা ততই বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষ ছাড়াও ভালো নেই নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে তাদেরও খাদ্য তালিকাসহ জীবনযাপনের পদ্ধতিও কাটছাট করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে দেশেও বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির প্রভাবে জুন মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা গত মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারও মে মাস থেকে বেড়েছে জুন মাসে যা নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুন মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, গত মে মাসে যা ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। 

বিবিএস পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এ বছর মে মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের মে মাসে যে খাদ্যপণ্য বা খাবারের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, চলতি বছরের মে মাসে একই খাবারের জন্য ১০৮ টাকা ৩০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এছাড়া এ বছর জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত প্রসাধন সামগ্রী, জুতা, পরিধেয় বস্ত্র, বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালী পণ্য, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণ এবং বিবিধ সেবা খাতের মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এছাড়া জুলাই মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ব্রয়লার মুরগি, শাক-সবজি, ফল, মসলা, দুগ্ধজাতীয় ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী কিনতে বিপাকে পড়ছেন ক্রেতারা। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় পণ্যমূল্য ও অন্যান্য সেবার দাম বেড়েছে বেশি। জুন মাসে গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, যেখানে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। ফলে শহর থেকে গ্রামের মানুষ আরও ভুগছে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে।

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা করেন সুমন খান। এই ব্যবসা থেকে তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। এই আয়ের বড় অংশ অর্থাৎ ১৮ হাজার টাকা শুধু বাড়িভাড়াতেই খরচ হয় তার। বাকি টাকা দিয়ে চলে বাজার খরচসহ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ। মূল্যস্ফীতির ফলে নিয়মিত তার ব্যয় বাড়তে থাকায় খাদ্য তালিকার সঙ্গে তার জীবনযাপনের পদ্ধতিতেও রদবদল করেছেন। সুমন বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে এখন অনেক কিছুই খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বাহিরে চলাচলে আগে যেখানে রিকশায় যেতাম সেখানে এখন পায়ে হেঁটে বা বাসে চলাফেরা করি। সন্তানের জন্য বাসায় টিচার রেখেছিলাম। তাকেও না করেছি তিন মাস আগে। এখন ওর আম্মুই যতটুকু পারে পড়ায়। আমার বড় মেয়েটা রিকশায় করে স্কুলে যাওয়া আসা করতো। এখন শুধু যাওয়ার সময় রিকশায় যায় আর আসার সময় হেঁটে আসে। এভাবেই সমন্বয় করার চেষ্টা করছি। 

অর্থনীতিবিদ, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, মূল্যস্ফীতির ফলে জনজীবনে অনেক প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ ছাড়াও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিশ্ববাজারে যদি ২০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পায় সেটা টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমাদের নিজস্ব বাজারে ৩৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। এটার প্রভাব আমদানিকৃত পণ্যের উপর পড়েছে। এতে আমাদের স্থানীয় উৎপাদনের উপরেও পড়েছে। কারণ ফুয়েল-গ্যাসের দাম বাড়লে তা পরিবহনের উপরেও পড়ে। সব মিলিয়ে একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ যেসব খাদ্য খায় সেগুলোর মূল্য বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপরে চাপ পড়েছে। এখন তাদের সঞ্চয় দিয়ে এটা সমন্বয় করতে হচ্ছে। যারা দরিদ্র তাদের ঋণ করতে হচ্ছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কারণ তাদের আয় সীমিত। দেশের অনেক মানুষের ক্রয় ক্ষমতা নাই। তাদের জন্য আরও কঠিন হয় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি। এটি নিয়ন্ত্রণে চাহিদা অনুযায়ী সকল পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। বিদেশ থেকে যেসব পণ্য আনা হয় সেগুলোর দাম বেড়ে গেলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রে ভর্তুকি না দিলে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে।

 

লাইফস্টাইল


শেয়ার