যেভাবে বুঝবেন শরীরে ক্যান্সার





শেয়ার

ডা. মাহমুদুল হাসান সরদার
 

ক্যান্সার নিয়ে বারবার লেখার একটাই উদ্দেশ্য ক্যান্সার রোগ ও এর সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন  করে তোলা ও ক্যান্সার রোগটি  সম্পর্কে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।  কেননা ক্যান্সার রোগ এর প্রতিরোধই হলো  সর্বোৎকৃষ্ট  চিকিৎসা। মনে রাখতে হবে শরীরের কোনো অংশে টিউমারের মতো ফোলা মাংসপিণ্ড দেখা দিলেই আঁতকে ওঠার কিছু নেই, অবহেলাও করবেন না।  দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং পরীক্ষা করিয়ে রোগ শনাক্ত করুন।

প্রকার: শরীরে সাধারণত দুই ধরনের টিউমার হয়ে থাকে। 
বেনাইন বা নন ম্যালিগনেন্ট টিউমার ও ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। অনেক সময় জন্ম থেকে অথবা ছোট বয়স থেকে শরীরের কোন অঙ্গে বেনাইন টিউমার থাকে। আবার শরীরের চামড়ার নিচে এ ধরনের টিউমার থাকে। এতে ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। বেনাইন টিউমারে ক্যান্সারের প্রবণতা থাকে না। এটি যে স্থানে হয় তার চারপাশের কোষ অথবা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে না। কিন্তু  এই বেনাইন ক্যান্সারও গুরুতর হতে পারে যদি সেটি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে যেমন রক্তের কোষে অথবা স্নায়ুতে হয়ে থাকে।

অনেক সময় আবার বেনাইন টিউমারের চিকিৎসারও দরকার হয় না। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে সারিয়ে ফেলা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একবার টিউমার বের করে দিলে পুনরায় তা ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।  আর ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকেই ক্যান্সার হয়। এই ধরনের টিউমারগুলি ধীরে ধীরে তার চারপাশের কোষ শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
 

 

টিউমার থেকে ক্যান্সার বোঝার সহজ উপায়

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকেই ক্যান্সার হয়। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে কোষ বিভাজন হয়। তাই এই টিউমারের আকৃতি  বৃদ্ধি পেতে দেখলে অবশ্যই  চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিভিন্ন কারণে শরীরের কোনো জায়গায়  আঘাত পেলেও অনেক সময় ফোলা বা কাটা জায়গা থেকে ক্যান্সার হতে পারে। অনেক ধরনের ক্যান্সার ত্বকের মাধ্যমে অনুভূত হয়। এই ক্যান্সারগুলি  সাধারণত স্তন, অণ্ডকোষ বা শুক্রাশয়, নিঃসারক এবং শরীরের নরম কলাতে বেশি দেখা যায়। টিউমার বা যেকোনো ধরনের ফোলা মাংসপিণ্ড ক্যানসারের প্রাথমিক অথবা শেষ পর্যায়ে হতে পারে। প্রাথমিকভাবে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না। ফলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের প্রাথমিক পর্যায়ে সেভাবে কোনো নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা না গেলেও কিছুদিনের মধ্যে ওজন হ্রাস, অ্যানিমিয়া ইত্যাদি লক্ষণ চোখে পড়ে। যতই সেই ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমারের আকৃতি বাড়তে থাকে, ততই তা আশপাশের স্নায়ু এবং পেশিগুলিতে চাপ দেয়। আর তখনই ব্যথা বা যন্ত্রণা অনুভূত হয়। 

উপসর্গ
১)  ফুসফুস ক্যান্সার: শুকনো বা দীর্ঘদিনের কাশি, কাশতে কাশতে প্রায়ই কফের সঙ্গে রক্ত বেরোনো, বুকে ব্যথা, ওজন হ্রাস, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ইত্যাদি। 
২) লিম্ফোমা ক্যান্সার: লসিকার আকৃতি বৃদ্ধি, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস। 
৩) স্তন ক্যান্সার: স্তনে টিউমার বা মাংসপিণ্ড, স্তন বৃন্ত থেকে রক্ত নিঃসরণ, স্তন ও স্তনবৃন্তের আকার এবং ধরনের পরিবর্তন। 
৪) প্রস্টেট ক্যান্সার: সাধারণভাবে প্রস্রাবে সমস্যা হলেও কখনো কখনো কোনো উপসর্গই বোঝা যায় না। তবে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
৫) বোসাল সেল ক্যান্সার: মূলত: মুখ এবং গলার মতো যেসব অংশে সূর্যের আলো পড়ে এমন জায়গায় একটি সাদা টিউমার অথবা বাদামি রঙের ছোপ দাগ দেখা যায়। 
৬) মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার: শরীরের যেকোনো অংশে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অথবা শরীরের কোনো আঁচিলের আকারের পরিবর্তন। 
৭) কোলন ক্যান্সার: এটি ক্যান্সারের স্থান এবং আকৃতির উপর নির্ভর করে। সাধারণত মলত্যাগে সমস্যা, মলের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া এবং পেটে অস্বস্তি বোধ হওয়া।
৮) লিউকিমিয়া: ধীর গতিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই ক্যান্সারের রোগীদের অনেক সময় কোনো উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায় না দ্রুত বৃদ্ধি পেলে দুর্বলতা, ওজন হ্রাস, সহজে রক্তক্ষরণ, মাথাব্যথা, ঘাম হওয়া, অনবরত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত হওয়া, নিঃশ্বাসে কষ্ট, ত্বকে লাল লাল ফুসকুড়ি ইত্যাদি।
৯) এছাড়া ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকে আরও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হঠাৎ করে খিদে কমে যাওয়া, ওজন হ্রাস, রক্ত স্বল্পতা, মলের সঙ্গে রক্ত ইত্যাদি যেকোনো কিছু ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস থেকে জরায়ুর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। তাই এই ধরনের কোনো উপসর্গ শরীরে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 
ক্যান্সার  প্রতিরোধে  করণীয়

১) তামাক জাতীয় পণ্য বা নেশা জাতীয় পণ্য  পরিহার করুন।
২) স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রা মেনে চলুন।
৩)  সাধারণ টি এর পরিবর্তে গ্রিণ টি পান করুন।
৪) খাদ্য তালিকায় পিয়াজ, রসুন রাখুন ও আদা রাখুন।
৫) দীর্ঘদিনের সংরক্ষণ করে রাখা খাবার বর্জন করুন।
৬) প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করবেন না।
৭) নির্দিষ্ট বয়সে নারীদের এইচপিভি ভাইরাসের টিকা নেয়া।
৮) নারীদের নিয়মিত ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা উচিত।

ক্যান্সার নিয়ে ভুল 
১) ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়।  শুরুর পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে ক্যান্সার সেরে যায়। এর জন্য সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।
২) ক্যান্সার ৫% বংশগত। তাই অযথা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
৩) ক্যানসারে অপারেশন করা উচিত নয়, এই ধারণা একেবারেই ভুল। বায়োপসি করলে ছড়িয়ে পড়ে, এমনটা ভাবাও ঠিক নয়। কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্মূল করা সম্ভব। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ভয় পেয়ে অনেকটা দেরি করে ফেলেন। ফলে ততদিনে ক্যান্সারের আকারও বেড়ে যায় এবং পরিণতিতে  মৃত্যুবরণও করতে হয়।
 

লেখক: হোমিও চিকিৎসক ও ক্যান্সার গবেষক 
সরদার হোমিও হল ৬১/সি আসাদ এভিনিউ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। 
সেল-০১৭৪৭৫০৫৯৫৫

 

লাইফস্টাইল


শেয়ার